সরস্বতী
স্কুল জীবনে পরীক্ষায় ভাল নম্বর না পাওয়াটা ছিল লজ্জার বিষয়, কিন্তু ভুলটা যে ঠিক কোথায় হল, তার উত্তর খুব কম মানষের কাছ থেকেই পেয়েছি

২০০৯ সালের সরস্বতী পূজোর আগের রাতে আমি আমার কম্পিউটার দিয়ে আরেকটা ছোট কম্পিউটার জাতীয় জিনিস চালানোর চেষ্টা করছিলাম। প্রায় রাত ২টো, বাবা মা ঘুমিয়ে পড়েছে, আমার ঘুমে চোখটা বুজে আসছে, কিন্তু জিনিসটা চলছে না কেন সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। ইন্টারনেট যেটা জানিয়েছে সেটা অবলম্বন করলেই যে ব্যাপারটা চলবে না, সেটা তখনও বুঝিনি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সবে ঢুকেছি, আদৌ ইঞ্জিনিয়ারিং মানে কী সেটা জানি না। আমার সামনে একটা ইলেকট্রিক তারের জটলা, দুটো কম্পিউটারের মধ্যে যোগাযোগের জন্য প্রায় ১২ খানা তার, তাছারা আরো অনেক রকম জিনিস তো রয়েইছে। একটু কান্না পেয়ে গেছিল সেদিন।
বোধ হয় জিনিসটা শেষমেষ ২০১০ সাল নাগাদ করতে পেরেছিলাম, যেদিন করতে পেরেছিলাম, খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু তার আগের বছর সরস্বতী ঠাকুর যে খুব একটা ব্যাপারটা এগিয়ে দেবেন না, সেটা টের পেয়েছিলাম। আমার সেই project-টা অনেকটাই সহজ হত, যদি কেউ আমাকে বলে দিত আমার ভুলটা কোথায়। কিন্তু সেদিন ছিল না সেরম কেউ; ছিল না বলে অনেক কিছু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে শেখা হয়েছে। কিন্তু মনে হয়, মানুষ পাথরকে (silicon) ভাবতে শিখিয়ে দিল কম্পিউটার বানানোর চক্করে, আমাকে কি কেউ বলে দিতে পারত না কীভাবে সেদিন আমার কাজটা হাসিল করা যেতে পারে! নিজে কিছু শেখা খুব কঠীন, কোন জিনিস যদি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ না করা যায়, অথবা অন্য কাজের সাথে মেলানো না যায়, তাহলে ঠিক শেখা হল কিনা সেটা জানা যায়না, আর ভুলটা গায়ে লেগে থাকে হাঁটুতে পুরনো চোট এর মত। অনেক সময় অনেক বছর পরে কেউ পেন আর কাগজ নিয়ে বসে ধৈর্য ধরে ভুলটা ঠিক করে দিতে পারে, কিন্তু সেরম মানুষের সন্ধান পাওয়াও ভাগ্যের বিষয়।
স্কুল জীবনে পরীক্ষায় ভাল নম্বর না পাওয়াটা ছিল লজ্জার বিষয়, কিন্তু ভুলটা যে ঠিক কোথায় হল, তার উত্তর খুব কম মানষের কাছ থেকেই পেয়েছি। পরীক্ষায় ভাল নম্বর আমি কোন দিনও পাইনি, তার জন্য আমাকে খুব বেশি কথা কেউ বলেনি কোনদিনও, বাড়ির সবাই যে পরীক্ষায় খুব একটা বিশ্বাস করত সেরম নয়, তবে নম্বরের সাথে নিজের জীবনের ওজন মাপার কথাটা আমার ছোটবেলার সমাজ খুব ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছে, এতটাই ভাল করে বুঝিয়েছে যে এখনো পরীক্ষা আর আলোচনার ফারাক টা বুঝতে অসুবিধা হয়। অথচ পরীক্ষা যে আসলে একটা শেখার মাঝে যে একটা boss-fight-এর মত, সেটা বুঝতে পারলাম অনেক পর। ভাল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করে লিখতে পারাটা আনন্দের, সেটা বুঝতে পারলাম ছাত্রবেলার শেষের দিকে। একবার একটা পরীক্ষায় একটাই প্রশ্নের উত্তর লিখে এসেছিলাম; ভাল লাগছে লিখতে, আমি যে ভেবেছি বিষয়টি নিয়ে, সেটা নিয়ে লেখার জন্য আরও দুটো পাতা চেয়ে নিলাম, ফেল করলেও কিছু এসে যায় না, শেষে ৫০-এ ৬।
পরীক্ষা দিতে আমার ভালই লাগে এখন... কঠিন ধাঁধায় মাথা ঠুকতে আনন্দ হয়। বন্ধুরা ভুল ধরিয়ে দিলেও লজ্জা করেনা। কঠিন খেলায় হেরে গেলেও আর একবার খেলতে ইচ্ছে করে। পায়ে ব্যাথা হলেও আরও ৫০ কিমি. সাইকেলে যেতে ইচ্ছে করে। কেউ জিজ্ঞেস করেনা যে, কত পেলি।